ব্যবসায়ী শব্দটি বলতে একজন প্রতিষ্ঠাতা মালিক বা একটি বাণিজ্যিক উদ্যোগের সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ার হোল্ডারদের বোঝানো হয়।শব্দটি দিয়ে কোন করপোরেশন এন্টারপ্রাইজ ফার্ম অথবা কোন সংস্থার বিনিয়োগকারীকেও বোঝানো হয়ে থাকে।ব্যবসায়ীদের ব্যবসার মূল উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন। এই মুনাফা অর্জনের নীতি হলো তাদের একমাত্র পরিচয়।
টিআইবির গবেষণায় দেখা যায় বাংলাদেশে রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের প্রভাব অনেকাংশে বেড়ে গেছে।বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গুলোতে আমরা দেখতে পাই রাজনীতি যেন ব্যবসায়ী নীতিতে পরিণত হয়েছে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদের ব্যবসায়ীদের সংখ্যা ছিল ১৮ শতাংশ।
রওনক জাহান তাঁর বাংলাদেশ পলিটিকস: প্রবলেমস অ্যান্ড ইস্যুজ বইয়ে লিখেছেন, প্রথম জাতীয় সংসদে ২৮৩ আসনের মধ্যে সাড়ে ২৫ শতাংশ আইনজীবী, ২৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ ব্যবসায়ী, ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ কৃষক, শিক্ষক ৯ দশমিক ৮৯ এবং ১২ দশমিক ৩৬ শতাংশ রাজনীতিবিদ ছিলেন
সুজন ও টিআইবির তথ্য বলছে, ১৯৯১ সালে পঞ্চম সংসদে ব্যবসায়ীদের হার বেড়ে ৩৮ শতাংশ হয়। আর ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী ৩০০ জন সদস্যের মধ্যে ৬২ শতাংশই ছিলেন ব্যবসায়ী। বাকিদের মধ্যে আইনজীবী ১৪ শতাংশ, কৃষিজীবী ৪ শতাংশ এবং রাজনীতিবিদ ছিলেন ৭ শতাংশ।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের বিপরীতে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা ছিল ১৮২ জন।কিন্তু সব রেকর্ড ভেঙ্গে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা দাড়ায় ১৯৯ যা মোট সংসদ সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশ
মনোনয়নপত্রের সঙ্গে প্রার্থীরা যে হলফনামা দিয়েছেন, তা বিশ্লেষণ করে নাগরিক অধিকার সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) জানায়, নির্বাচনে ১ হাজার ৯৪৫ জন প্রার্থীর মধ্যে ১ হাজার ১৪২ জনই ছিলেন ব্যবসায়ী (৫৮ দশমিক ৭১ শতাংশ)।এ ছাড়াও এর বাইরে নির্বাচিত যে ৪০ জন নিজেদের রাজনীতিবিদ ও কৃষিজীবী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকের মূল পেশা ব্যবসা।
বর্তমানে একজন রাজনৈতিক নেতা বা সংসদ-সদস্য হওয়ার আকর্ষণটা হচ্ছে, রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ক্ষমতা ও আধিপত্য বিস্তার এবং জাতীয় পর্যায়েরও কিছু ক্ষেত্র নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে প্রভাব বিস্তার করে বিত্তশালি হওয়া। ব্যবসায়ীরা এ কারণেই অর্থের বিনিময়ে ক্ষমতা ও আধিপত্য এবং সহজে অর্থবিত্তের মালিক হতে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। তারপর সংসদ-সদস্য ও পরের ধাপে কেউ কেউ উপদেষ্টা বা মন্ত্রী হন। এরপর তার ‘ভাগ্য’ তিনি নিজে নিজের মতো করে গড়ে তোলার অবারিত সুযোগ সৃষ্টি করে নেন। এটা তারা হয়তো ‘রাজনৈতিক বিনিয়োগ’ হিসাবেই দেখেন।
এ প্রসঙ্গে ডা. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন—
রাষ্ট্রীয় সম্পদে অধিকার পাওয়ার জন্য নাগরিক অধিকারের চেয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে ঢুকতে পারলে অ্যাকসেস টু স্টেট রিসোর্সেসের এটাই সবচেয়ে ভালো রাস্তা। আপনি যদি তার সঙ্গে থাকতে পারেন তাহলে ভাগ-বাটোয়ারাটার কিছু অংশ আপনি পাবেন, যা নাগরিক হিসেবে পাবেন না। ওই অংশের অংশ হিসেবে আপনি এটা পাবেন। অর্থাৎ পুরো রাষ্ট্রকে আপনি অধিকারহীন করে দিয়ে, সংকীর্ণ গোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অধিকার ও মালিকানা দিচ্ছেন। এটাই হচ্ছে এই চরিত্রের নির্বাচনের সবচেয়ে বড় কুফল।
বিগত সরকার ও নির্বাচনে ব্যবসায়ী সংসদ সদস্যের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে বুঝা যায়, স্বভাবগতভাবেই ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা হয়েছে।রাজনীতিবিদ রাষ্ট্রের স্বার্থে জনকল্যাণমূলক কাজ করে, ব্যবসায়ীরা মুনাফা অর্জন করতে ব্যস্ত থাকে, তাহলে ব্যবসায়ীরা যদি রাজনীতিবিদ হয়ে যায় রাষ্ট্রের মুনাফা অর্থাৎ জনগণের কথা বাদ দিয়ে নিজের স্বার্থেই পড়ে থাকবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতে, ‘রাজনৈতিক অখণ্ডতার (Political Integrity) অর্থ হচ্ছে জনস্বার্থে ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করা, ব্যক্তিগত স্বার্থ থেকে স্বাধীন হওয়া এবং অফিসধারীর নিজস্ব সম্পদ ও অবস্থান বজায় রাখার জন্য ক্ষমতা ব্যবহার না করা।’ এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের রাজনীতি করা বিষয়টি জনস্বার্থের বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে; রাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য যা অশুভ, অকল্যাণকর ও জনকল্যাণের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
সাধারণভাবে একজন সংসদ সদস্যের কাজ চারটি।
১. আইন প্রণয়ন।
২. জাতীয় ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যুক্তিপূর্ণ বিতর্ক ও মতামত তুলে ধরা।
৩. সরকারের আয়-ব্যয়, বার্ষিক বাজেট পরিকল্পনার অনুমোদন দেওয়া।
৪. সংসদীয় কমিটিগুলোর মাধ্যমে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
আমাদের বিগত সংসদ গুলোতে কি আমরা এ ৪ টি কাজ সংসদ সদস্যদের করতে দেখেছি?
যত বারই নির্বাচন হয় আমরা সান্ত্বনা পাই এমন করা হবে, ওমন করা হবে কিন্তু সব সময় সাধারন মানুষ ভোগান্তির স্বীকার হয়,দ্রবমূল্যের উর্ধ্ব গতি,অর্থনীতির ধস,মুদ্রাস্ফীতি,আমলা ও ব্যবসায়িদের একচেটিয়া নীতি,ঋনখেলাপি,ব্যাংকিং সেক্টরের ধস,সহ নানা নতুন নতুন সমস্যার সামনে জনগনকে দাড়াঁতে হয়।
বিগত সময়ে যে যেভাবে ব্যবসায়ীরা সংসদে আধিপত্য করেছে এতে ধনীশ্রেনীই সব সুবিধা ভোগ করেছে, সাধারন জনগন শোষনের স্বীকার হয়েছে।
তাই সুন্দর, জনবান্ধন, বাংলাদেশ বিনির্মানে ব্যবসায়ী মুক্ত জাতীয় সংসদ চাই।
লেখকঃ শিক্ষক
Leave a Reply