উপ-সম্পাদকীয়ঃ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মানুষের “মৌলিক অধিকার” বিষয়ে বলা হয়েছে। সংবিধানের ২৬নং অনুচ্ছেদ মতে- মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো আইন করা যাবেনা। আর যদি করা হয় তবে তা স্বত:সিদ্ধভাবে বাতিল বলে গণ্য হবে। মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী পূর্বেকার সকল আইন সাংবিধানিকভাবে অবৈধ। সংবিধানের চতুর্থ পরিচ্ছেদের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুসারে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ-কে মৌলিক অধিকার বলবৎ করার এখতিয়ার দিয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য সংবিধান স্বীকৃত ১৮টি মৌলিক অধিকার রয়েছে, যথা- (১) আইনের দৃষ্টিতে সমতা। (২) ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য। (৩) নারী-পুরুষের সমঅধিকার। (৪) সরকারী নিয়োগ লাভে সমতা। (৫) আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার। (৬) জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা লাভের অধিকার। (৭) গ্রেফতার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ। (৮) জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধকরণ। (৯) বিচার ও দন্ড সম্পর্কে কতিপয় অধিকার। (১০) চলাফেরার স্বাধীনতা। (১১) সমাবেশের অধিকার। (১২) সংগঠনের স্বাধীনতা। (১৩) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা। (১৪) পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা। (১৫) ধর্মীয় স্বাধীনতা। (১৬) সম্পত্তির অধিকার। (১৭) গৃহ ও যোগাযোগ। (১৮) মৌলিক অধিকার বলবৎকরণ। যদি কোনো ব্যক্তির মৌলিক অধিকার লংঘিত হয়, তবে তিনি মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রিট আবেদন করতে পারবেন। মৌলিক অধিকার সমূহের মধ্যে জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা লাভের অধিকার সম্পর্কে বিশেষভাবে আলোকপাত করতে চাই। মানুষের জীবন ধারণের অন্যতম উপকরণ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা। প্রতিটি নাগরিকের এই অধিকার সমূহ আছে। মানুষের জীবন বাঁচাতে হলে অসুস্থ ব্যক্তির চিকিৎসা প্রয়োজন। যদি কোনো অসুস্থ ব্যক্তি যথাসময়ে চিকিৎসা না পায়, তবে তার মৃত্যু হতে পারে। বাংলাদেশে সরকারীভাবে চিকিৎসা ব্যবস্থা যুযোপযোগী ও রোগীবান্ধব নয়। সরকারী হাসপাতাল সমূহে রোগীদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে সুযোগ-সুবিধা নেই। পর্যাপ্ত চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নেই। পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি নেই। একটি সরকারী হাসপাতালে যতটুকু সুযোগ সুবিধা রয়েছে তাও যথাযথভাবে ব্যবহার হয়না। বাস্তবতায় দেখা গিয়েছে যে, চিকিৎসকের আদেশকে উপেক্ষা করে কতিপয়-কর্মচারী প্রতিনিয়ত দুর্নীতি করছে। সরকারী প্রতিটি বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানে কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ক্রমাগতভাবে দুর্নীতি করে জনসাধারণকে প্রাপ্য অধিকার হতে বঞ্চিত করে যাচ্ছে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রনে সরকারকে আরো জোরালো ও কঠোর ভূমিকা নিতে হবে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে আইন সংশোধন, সংযোজন এবং প্রয়োজনে নতুন আইন করা যেতে পারে। পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সৎ, দক্ষ ও যোগ্য লোকদের মূল্যায়ন করে যথাযোগ্য পদে আসীন করা জরুরী।
আমরা ১৯৪১ সনে উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। বাংলাদেশ-কে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতে হলে রাষ্ট্রের প্রতিটি বিভাগ, প্রতিটি অফিস-আদালত, প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে। উন্নত বাংলাদেশের পূর্বশর্ত নাগরিকদের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়ন করতে হবে। মানুষের মৌলিক অধিকার সমূহ বাস্তবায়ন না হলে শুধুমাত্র দেশের দৃশ্যমান উন্নয়ন তথা- সেতু নির্মাণ, রাস্তা-ঘাট, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বিদুৎ ও জ¦ালানী সংকট নিরসন ইত্যাদি দ্বারা উন্নত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়; তবে এই কাজগুলি উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপক্ষে অবশ্যই প্রয়োজন। উন্নত বাংলাদেশ গড়তে হলে সর্বপ্রথম মানুষের জীবনের মান-উন্নয়ন প্রয়োজন। প্রতিটি নাগরিকের জন্য রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বিশেষ করে অস্বচ্ছল, দু:স্থ, কর্মঅক্ষম বেকার জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারিভাবে সহায়তা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে বাংলাদেশে মাত্র ৩০০ লোকের পুর্নবাসন এর ব্যবস্থা আছে, যা চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। দু:স্থ, এতিম, অস্বচ্ছল ব্যক্তিদের জন্য সরকারী অর্থায়নে আরো পুর্নবাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা কারা প্রয়োজন। বেকারত্ব নিরসন, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সরকারী সেবা খাত সমূহে যুগান্তকারী সংস্কার প্রয়োজন। আরো লক্ষ্যনীয় যে, একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান হতে মানুষ যেভাবে সেবা পেয়ে থাকে; সরকারী প্রতিষ্ঠান সমূহ সে তুলনায় অনেক পিছিয়ে। অনেকেই মনে করে- সরকারী চাকরি যেন নিজের বাপ-দাদার গদিতে বসে থাকা এবং চেয়ার পেলে যা ইচ্ছা তাই করা যায়। সরকারী চাকরিতে আরো স্বচ্ছতা, জবাবদিহীতা আনা প্রয়োজন, যাতে কেউ দুর্নীতি করতে না পারে এবং নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকে। কিছুদিন আগে দেখলাম বাংলাদেশ ডাক বিভাগে চাকরিতে যোগদানের পূর্বশর্ত হিসেবে “যৌতুক নিবনা” মর্মে অঙ্গীকারনামা নিচ্ছে। একই প্রক্রিয়ায় সরকারী চাকরিতে নিয়োগের পূর্বে “দুর্নীতি করবনা” মর্মে তিনশত টাকা মূল্যমানের নন-জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পে অঙ্গীকারনামা নেয়া যায় কিনা সংশ্লিষ্টদের ভেবে দেখার সময় এসেছে। শুধু সরকারী নই, বেসরকারী ক্ষেত্রেও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে মানুষের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়ন সম্ভব হবেনা এবং উন্নত বাংলাদেশ গড়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। সরকার ইতিমধ্যে নাগরিকদের সুবিধার্থে নাগরিক সেবার জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তারপরও দুর্নীতিবাজরা অবলীলায় নানা অপকৌশলে দুর্নীতি করে যাচ্ছে। সংবিধানে ধর্মীয় স্বাধীনতা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও এখনও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন ধর্ম পালনে নানাভাবে বাঁধাগ্রস্থ হয়। সময়ে সময়ে সাম্প্রদায়িক হামলার খবর পত্র-পত্রিকায় ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। এখনও ধর্মীয় বৈষম্যের কারণে মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। নারী-পুরুষের সম-অধিকার সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার হলেও বাস্তবে সকল ক্ষেত্রে নারীরা এই অধিকার ভোগ করতে পারেনা। সরকারী নিয়োগে সমতার কথা সংবিধানে উল্লেখ থাকলেও কার্যত তা নেই। সমাবেশের স্বাধীনতা থাকলেও রাজনৈতিক সমাবেশে প্রায়শ: বাঁধা-নিষেধ দেখা যায়। সম্পত্তির অধিকার সাংবিধানিক অধিকার হলেও অনেকই এই অধিকার হতে বঞ্চিত হচ্ছে। অনেকেই অধিকার আদায়ের জন্য আদালতের মামলা করতে বাধ্য হচ্ছে। সরকারী স্কুল, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ সমূহে চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত আসন নেই। ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা বেসরকারী স্কুল, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ সমূহ লেখাপড়া করতে বাধ্য হচ্ছে। সরকারী স্কুল, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ সমূহে আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। শিক্ষার মান বৃদ্ধি কল্পে সরকারকে আরো উদ্যোগী ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন। অনেক মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে। এই ব্যবস্থা হতে উত্তরণ হওয়া প্রয়োজন। কোনো লোক যাতে অনাহারে, অর্ধাহারে দিনাতিপাত না করে সরকারকেই সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতিটি মানুষের জীবন ধারণ সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার। প্রতিটি মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে (যতদিন স্রষ্টা বাঁচিয়ে রাখে)। সংবিধানের ৩৯নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশের নাগরিকদের চিন্তা, বিবেক, বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার পাশাপাশি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিয়েছে। তারপরও মাঝে মধ্যে দেখা যায় সাংবাদিকের উপর মামলা-হামলা, সাংবাদিক হত্যার মত ঘটনা ঘটছে। সচিবালয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম হেনস্থার শিকার হয়েছিল। সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যা মামলার বিচার এখনও হয়নি। আমরা প্রত্যাশা করি ১৯৪১ সনে উন্নত বাংলাদেশ গড়তে সরকার সহসায় মৌলিক অধিকার সমূহ বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেবে এবং তৎ লক্ষ্যে যাই করণীয় তাই করবে।
লেখক:সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।